থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। এই রোগ শরীরে রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে যা রক্তের মধ্যে ত্রুটিযুক্ত হিমোগ্লোবিনের জন্য হয়ে থাকে। হিমোগ্লোবিন মানুষের রক্তের খুব দরকারি একটি উপাদান। এটি রক্তের একটি বিশেষ রঞ্জক পদার্থ যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে। স্বাভাবিক মানুষের রক্তে হিমোগ্লোবিন সাধারণত দু’টি আলফা ও দু’টি বিটা চেইন বহন করে। এ দু’টি চেইনের যে কোনো একটি পরিমাণে কম থাকলে সৃষ্টি হয় থ্যালাসেমিয়া রোগের।
মরণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত একটি রোগ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি নারী-পুরুষ নিজের অজান্তে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মায়।
মরণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া বেশির ভাগ রোগী রক্তস্বল্পতায় ভোগে। প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ পরপর তাদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওষুধ এবং অন্যের কাছ থেকে রক্ত নিতে হয়। এটি আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে থ্যালাসেমিয়া রোগের স্থায়ী চিকিৎসা নেই। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছে ‘ব্যোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ ও জীন থ্যারাপি। তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল।অথচ একটু সতর্কতা অবলম্বন করা হলেই এই মর্মান্তিক পরিণতি এড়ানো যাবে। তাই রোগটি প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি আমাদের সবার দায়িত্ব।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকার ভেদ:
- থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া বেটা থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়াবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
- বিশ্বে বেটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনও কখনও ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
আলফা থ্যালাসেমিয়া:-
- এই রোগের জন্য 16 নং ক্রোমোজোমে উপস্থিত আলফা-শৃঙ্খল উৎপাদনকারী জিনের mutation বা deletion দায়ী।চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া শিকল তৈরি হয়। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে।যেমন :একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে।
- দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Alpha-thalassemia minor) অথবা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট ( Alpha-thalassemia trait).
- তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ (Hemoglobin H Disease)।
- চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Alpha thalassemia major) অথবা হাইড্রপস ফিটালিস(Hydrops fetalis)। এর ফলে প্রসবের (delivery) পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।
বিটা থ্যালাসেমিয়া:-
- একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Beta-thalassemia minor) অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Beta-thalassemia trait).
- দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( Beta-thalassemia major) অথবা কুলিস অ্যানিমিয়া(Cooley’s anemia)। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ সমূহ:-
এই রোগের উপসর্গ শিশুর জন্মের ৩-১৮ মাসের মধ্যে শুরু হয়। এর বিভিন্ন উপসর্গ রয়েছে। যেমন-
*দেহে অতিরিক্ত সংক্রমণ
*অস্বাভাবিক অস্থির আকার/আকৃতি
*প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া
*অবসাদ অনুভব
*শ্বাসকষ্ট।
*মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
*ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)
*ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি।
*পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয।
*গাঢ় রঙের প্রস্রাব।
*হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি।
কথায় আছে Prevention is better than cure. কথাটি থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য। একটি বিশেষ রক্তপরীক্ষা (HB Electrophoresis) এর মাধ্যমে জেনে নেয়া সম্ভব কেউ এই রোগের বাহক কিনা। একজন বাহকের সাথে সুস্থ্য মানুষের বিবাহে এই রোগ পরবর্তী প্রজন্মে আসে না। সুতরাং দুইজন বাহকের বিবাহবন্ধন থেকে বিরত থাকা উচিত। এছাড়াও আগেই বাহক হিসেবে জেনে গেলে জেনেটিক কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে আক্রান্ত জিনটি শিশুদেহে প্রবেশ থেকে আটকানো যায়, ফলে শিশুতে এই রোগটি আর হয়না।
তাই, আমাদের উচিত সচেতন হওয়া এবং অন্যদেরকে সচেতন করা। একমাত্র সচেতনাই থ্যালাসেমিয়া রোগকে প্রতিরোধ করা যাবে।
নিচে বাহক, রোগী এবং সুস্থ মানুষ বিয়ে করলে কি হবে, তা বর্ণনা করা হলোঃ-
-দুইজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক যদি বিয়ে করে তাহলে তাদের অনাগত সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% এবং সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%
-দুইজন থ্যালাসেমিয়া রোগী বিয়ে করলে তাদের অনাগত সন্তান অবশ্যই অবশ্যই রোগী হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বাচ্চা সুস্থ জন্ম নিবেনা।
-একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক এবং একজন সম্পূর্ণ সুস্থ্য মানুষ (যে বাহক নয়) যদি বিয়ে করে তাহলে তাদের অনাগত সন্তান ৫০% সম্ভাবনা থাকে বাহক হওয়ার এবং ৫০% সম্ভাবনা থাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার
-একজন বাহক এবং একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী হলে তাদের অনাগত সন্তানের রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০% এবং বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০%
-একজন সুস্থ মানুষ এবং একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী বিয়ে করলে তাদের অনাগত সন্তানদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। শুধু বাহক হওয়া সম্ভাবনা ১০০%
-দুইজন সুস্থ মানুষ (যারা বাহক নয়) তারা যদি বিয়ে করে তাহলে তাদের অনাগত সন্তানদের মধ্যে বাহক এবং রোগী হওয়ার সম্ভাবনা নাই। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সুস্থ হবে।
আমাদের দেশে প্রায় ১ কোটি ৫০ হাজার পুরুষ এবং মহিলা থ্যালাসেমিয়ার বাহক। তাই আমাদের দেশে প্রতি বছর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়ে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৭ হাজার শিশু। এবং বর্তমানে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা ৬০হাজার। থ্যালাসেমিয়া মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের প্রয়োজন নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যকে সচেতন করা।
থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে গেলেই কয়েকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়
১. থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা ক্যারিয়ার কি?
উঃ আমাদের শরীরের সকল বৈশিষ্ট্য যেমন চুলের রঙ, গায়ের রঙ, উচ্চতা ইত্যাদি যা দ্বারা নির্ধারিত হয় তার নাম হচ্ছে জীন। প্রতিটা বৈশিষ্ট্যের জন্য একেকটা জীন দায়ী। জীন গুলো জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একটা আসে বাবার কাছ থেকে আর অন্যটা মায়ের। এই জীনগুলো যখন ত্রুটিযুক্ত হয় তখন ই মানুষের বিভিন্ন জন্মগত রোগ হয়। বাহক হচ্ছে তারাই যারা বাবা মায়ের একজনের কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ আর অন্যজনের কাছ থেকে সুস্থ জীন পেয়েছেন।
২. থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা কি রোগী?
উঃ না না এবং না থালাসেমিয়ার বাহকরা রোগী নয়। তারা আপনার আমার মত সুস্থ মানুষ। আমার রক্ত পরিক্ষা করলে আমিও বাহক হিসেবে শনাক্ত হতে পারি। বাহকরা শুধুমাত্র ত্রুটিযুক্ত জীন বহন করে। একজোড়া জীনের মধ্যে অন্য জীনটি সুস্থ থাকায় ত্রুটিপূর্ণ জীনটি শরীরের কোন রকম ক্ষতি সাধন করতে পারেনা। তাই বাহকদের থ্যালাসেমিয়া রোগের কোন উপসর্গ থাকেনা।
৩. বাহকের সাথে বাহকের বিয়ে হলে কেন শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগ হয়?
উঃ যেহেতু জীন জোড়ার একটি আসে মা আর অন্যটি আসে বাবার কাছ থেকে। বাহকের সাথে বাহকের বিয়ে হলে বাবা মা উভয়ের ত্রুটিযুক্ত জীন সন্তানের মধ্যে আসার আশংকা থাকে। ফলে শিশু মরণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্ম নিতে পারে।
৪. তাহলে বাহক নির্ণয়ের উপায় কী?
উঃ হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে বাহক নির্ণয় করা হয়।